সদ্য প্রয়াত, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রধান স্থপতি বলা হয়। তিনি ছিলেন নরোশিমা রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন যা করেছিলেন, তার ফলেই সংস্কারের পথে এগিয়ে যেতে পেরেছিল ভারতের অর্থনীতি।
কিন্তু, মৃদুভাষী মানুষটি যে শুধুমাত্র অর্থনীতিতে দড় ছিলেন তাই নয়। তাঁর পছন্দের আরও একটি বিষয় ছিল - 'শায়েরি'! যার উদাহরণ পাওয়া যেত সংসদের 'ভিতর ও বাহিরে' - সর্বত্রই। বিশেষ করে তিনি যখন বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরকে আক্রমণ করতেন, তখন বিরোধী নেতানেত্রীদের আক্রমণের 'হাতিয়ার' হিসাবে বেছে নিতেন এই শায়েরিকেই!
সবথেকে বড় কথা, সংসদের অন্দরে মনমোহন যখন তাঁর এই অস্ত্র প্রয়োগ করতেন, তখন সরকার পক্ষের সাংসদরা তো বটেই, সেই 'অস্ত্রাঘাত' পুরো দমে উপভোগ করতেন বিরোধী শিবিরের জনপ্রতিনিধিরাও। অনেক সময়ে সেই শায়েরিতে থাকত নিখাত হাসির মোড়ক। সেই সময় সরকার ও বিরোধী - দুই পক্ষেই হাসির রোল উঠত।
এখন যে সংসদে কথায়-কথায় জনপ্রতিনিধিরা একে-অন্যের দিকে তেড়ে যান, ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করে বসেন, সেই সময় সেখানকার পরিবেশ ছিল একেবারেই অন্যরকম।
২০০৯ থেকে ২০১৪ - এই চার বছরে মনমোহনের শায়েরিকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন আরও একজন দুঁদে রাজনীতিক। সেই সময় তিনি ছিলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা (বা দলনেত্রী) - তিনি হলেন প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। শায়েরিতে মনমোহন ও সুষমার 'যুগলবন্দি' সবপক্ষের ঝানু রাজনীতিকদের মুখেই হাসি চওড়া করে দিত! বস্তুত, তাঁদের সেই 'লড়াই' ছিল সমৃদ্ধ এবং উপভোগ্য।
২০১১ সালের মার্চ মাস। সদ্য সামনে এসেছে উইকিলিকস কেলেঙ্কারি। তার জেরে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা নাকি ২০০৮ সালের আস্থা ভোটের সময় সাংসদদের ঘুষ দিয়েছিল।
এই অভিযোগ সামনে রেখে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে নিশানা করলেন বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ। সাহাব জাফরির বিখ্য়াত শায়েরি 'ধার নিয়ে' বললেন -
'তু ইধার-উধার কি না বাত কর,
ইয়ে বাতা কি কাফিলা কিউ লুটা,
হামে রাহজানো সে গিলা নেহি,
তেরি রাহবারি কা সওয়াল হ্য়ায়!'
গোদা বাংলায় বললে, এর অর্থ হয় - 'আলোচনার বিষয়বস্তু ঘোরানোর চেষ্টা করবেন না। শুধু বলুন, যাত্রীদলকে লুট করলেন কেন। ডাকাতদের নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু, এটা তো আপনার নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল!'
সুষমার সেই শায়েরি-বাণের জবাব শায়েরি দিয়েই দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তিনি উদ্ধৃত করলেন আল্লামা ইকবালকে, বললেন -
'মানা কে তেরি দীদ কে কাবিল নেহি হু ম্যায়,
তু মেরা শওক দেখ, মেরা ইন্তেজার দেখ!'
এর অর্থ - 'আমি জানি, আমি তোমার নজরে আসার যোগ্য নই। কিন্তু, তুমি আমার আকাঙ্ক্ষা দেখ, আমার অপেক্ষা দেখ!'
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর এই স্পোর্ট্সম্যানশিপ, তাঁর এই জবাব বিরোধী দলনেত্রীর মুখেও হাসি এনে দিয়েছিল। খুশি মনে হর্ষধ্বনি শোনা গিয়েছিল সংসদের অন্দরে!