সাংবাদিক, লেখক থেকে এখন পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনী মুম্বইয়ে সাংবাদিক হিসাবে প্রায় দু দশক কাজ করেছেন। তাঁর প্রথম ছবি ছিল কেকওয়াক, গত মাসেই মুক্তি পেয়েছে তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘সিজনস গ্রিটিংস-আ ট্রিবিউট টু ঋতুপর্ণ ঘোষ’। নামই বলে দিচ্ছে এই ছবির মাধ্যমে ঋতুপর্ণ ঘোষকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন রামকমল। ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রয়াণ দিবসে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলায়র সঙ্গে একান্ত আড্ডায় ধরা দিলেন রাম কমল।
'মাস এবং ক্লাসকে এক করতে পেরেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ'
প্রত্যেক বাঙালির জীবনে যেমন সত্যজিত রায় আছেন,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন, যেমনভাবে ঋত্বিক ঘটক আছেন ঠিক তেমনভাবেই ঋতুপর্ণ ঘোষও আছেন। বাংলা সিনেমা একটা সময় ভেন্টিলেটরে চলে গিয়েছিল,মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি হলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। হয়ত যেসব সিনেমা রিলিজ করছিল সেগুলো তাঁদের রুচিসম্পন্ন মনে হয়নি। এরপর যখন উনিশে এপ্রিল মুক্তি পেল তখন থেকেই সেই সব মধ্যবিত্ত বাঙালিরা আবার হল ভরাল। বাঙালি একটা নতুন পরিচালককে পেল। যদিও উনিশে এপ্রিল ঋতুদার দ্বিতীয় ছবি,এর আগে হীরের আংটি তৈরি করেছিল ঋতুপর্ণ ঘোষ। কিন্তু ওই ছবিটা সেইভাবে মুক্তি পাবে। আমার বড় হওয়া,পড়াশোনা সবটাই তো কলকাতায়। তাই আমাকে আদ্যোপান্ত প্রভাবিত করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। মাস এবং ক্লাসকে এক করতে পেরেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।সেটা খুব কম পরিচালকই পেরেছেন। বাংলায় তরুণ মজুমদার প্রথম সেই কাজ করেছেন,এরপর ঋতুপর্ণ ঘোষ সেটা করে দেখিয়েছেন।
_00034_1590842467216.jpg)
‘আমার সঙ্গে ঋতুদার সম্পর্কটা ছিল লাভ আর হেটের’
ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে ঋতুদার সম্পর্কটা লাভ আর হেটের। ঋতুদার প্রচন্ড মুড সুইং হত। ঋতুদার আজ ভালো মুড তো কাল খুব খারাপ,এটা ওঁনার নেচার ছিল। আমরা সবাই সেটা মেনে নিয়েছিলাম। সাংবাদিক হিসাবেই ওঁনার সঙ্গে আমার পরিচয়,কিছু কিছু মনোমানিল্য ছিল। আমার কোনও লেখা ওঁনার পছন্দ না হলে ফোন করে ঝগড়া করত। আবার চমকে দিয়ে নিজে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে প্রশংসা করত আমার অনেক লেখা নিয়ে যেগুলোর সঙ্গে ঋতুদার কোনও সম্পর্ক নেই।উনি আসলে মানুষটাই এইরকম। উঁনার সেন্স অফ হিউম্যারের তারিফ না করলেই নয়।টুইটারে প্রথম যখন উনি ফলো করলেন আমি মেসেজ করে বলেছিলাম এটা কী তুমি? বলল,হ্যাঁ আর কে লিখবে এই ধরণের লেখা আমি ছাড়া? যখন আমি প্রীতিশ নন্দী কমিউনিকেশনে কাজ করতাম তখন ঋতুদার সঙ্গে অনেক ছবি নিয়ে কথা হয়েছে। খেলার শ্যুটিং কিছুটা বাকি,রাহাগীর বলে একটা ছবি প্ল্যান করেছিলেন ঋতুদা-অক্ষয় কুমার আর বিদ্যা বালানকে নিয়ে। গাইডের রিমেক,কিন্তু কোনও কারণে সেই ছবিটা আর হয়নি।

'ঋতুদা আমাকে নিঁখুত হওয়া শিখেছে'
ঋতুদার থেকে অনেক কিছু শিখেছি। নিঁখুত হওয়া-এটা আমাকে শিখিয়েছে। ঋতুদা বলত,কাজ তো অনেকেই করে কিন্তু পারফেক্টভাবে কজন করে? সবকাজে নিজেকে উজাড় করে দিতে হবে ঋতুদা বলত।আরেকটা জিনিস বারবার বতস সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে আমি মাস্টারমশাই হয়ে সবাইকে শেখাতে বসেছি এটা কোনওদিনই ভাববি না, জানবি একটা গল্প বলতে বসেছিস,সেটা করতে পারলেই মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারবি। সেটা আজও শিখে চলেছি। প্রতিদিন শিখি, ঋতুদার ছবি দেখলেই সেই অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
সিজিনস গ্রিটিংস ঋতুপর্ণ ঘোষকে দেওয়া একদম ভিন্ন ধরণের হোমেজ
ঋতুপর্ণ ঘোষকে ট্রিবিউট দেব বলে সিজনস গ্রিটিংসের চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে তেমন নয়,একটা চিত্রনাট্য লেখার পর আমার মনে হয়েছিল এই ছবিটার মাধ্যমে আমরা ঋতুদাকে খুব সুন্দরভাবে ট্রিবিউট দিতে পারি। মানে উল্টো ঘটনা বলতে পারো। হ্যাঁ,সেটা ভাবার পর জাতীয় স্তরের দর্শকদের কথা মাথায় রেখে ছবিতে অল্পবিস্তর কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। সাধারণত পরিচালককে ট্রিবিউট বলতে আমরা যা বুঝি,কোনও পরিচালকের বায়োপিক কিংবা তাঁর কোনও ফিল্মের রিমেক সিজনস গ্রিটিংস এক্কেবারেই সেটা নয়। এটা এক ভিন্ন ধরণের হোমেজ। যেখানে তাঁর নানান কাজের ঝলক এই ছবিটার মধ্যে দেখতে পাবেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের কাজ ছবি আপনি দেখে থাকেন তাহলে সিজনস গ্রিটিংস আরও বেশি করে এনজয় করতে পারেন।
সত্যি বলতে মা-মেয়ে বা বাবা-মেয়ের সম্পর্কের সূক্ষ্মতা বা টানাপোড়েনগুলো বাংলা চলচ্চিত্রে অন্তত ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো সুন্দর,সাবলীলভাবে কেউ তুলে ধরতে পারেননি।
_00893_(1)_1590842815451.jpg)
বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন দিশা দেখিয়েছেন ঋতুপর্ণ
ভালো ছবি এবং একসঙ্গে ব্যবসাসফল ছবি তৈরি করে দেখিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।ঋতুপর্ণ ঘোষের হাত ধরে বহু বলিউড অভিনেতা বাংলা ছবিতে কাজ করেছেন। ঐশ্বর্য রাই, অভিষেক বচ্চন, কিরণ খের, শর্মিলা ঠাকুর, রাখি গুলজার (ওনাদের দুজনকেই আমি বলিউডের অভিনেতা বলব), নন্দিতা দাস, বিপাশা বসু-অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত বলি তারকাকে নিয়ে উনি কাজ করেছেন। উনি সত্যি বলতে বাংলা ছবিতে জাতীয় স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। উনি বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। বাংলা ছবির বাজেটেই তিনি সেই কাজ করে দেখিয়েছেন, সেই দক্ষতাটা ঋতুপর্ণ ঘোষের মধ্যেই ছিল। লিমিটেশন ছিল তবে কাজের সঙ্গে কোনও আপোস করেননি।

সুযোগ পেলে দহনের রিমেক বানাব
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সুযোগ পেতে আমি ঋতুপর্ণ ঘোষের দহনের রিমেক বানাতে চাই। একদম আজকের প্রেক্ষাপটে এই ছবিটা আমি বানাতে চাই। ভেবেওছিলাম কিন্তু হয়ে উঠেনি। কেউ যদি সমর্থনে এগিয়ে আসেন, আমার ভিশনের সঙ্গে একমত হবেন তাহলে দহনটা হয়ত আমি বানাতে চাইব। অবশ্যই হিন্দিতে, জাতীয় স্তরের দর্শকদের কথা মাথায় রেখেই।